GEOFACTS

ভূমিকম্প বিধ্বস্ত মায়ানমার কিন্তু কেন?

ভূমিকম্প বিধ্বস্ত মায়ানমার কিন্তু কেন?

চিলির ভূমিকম্পের ভয়াবহতার কথা আমরা সবাই শুনেছি। মায়ানমারের ভূমিকম্প আমাদের ১৯৬০ সালের চিলির ভূমিকম্প আবার মনে করিয়ে দিল।মায়নামারের মান্দালয়ের নিকট সাগাইং শহরের 16 কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে একটি তীব্র ভূমিকম্প আঘাত হানে রিখটার স্কেলে যার মাত্রা ছিল ৭.৭ এবং কেন্দ্র ছিল ১০ কিলোমিটার গভীরে।

  • তারিখ: ২৮ শে মার্চ ২০২৫
  • স্থানীয় সময়: দুপুর ১২ঃ৫০ মিনিট।
  • কম্পনের মাত্রা: রিখটার ৭.৭
  • ভূমিকম্পের উপকেন্দ্র: মায়নামারের মান্দালয়ের নিকট সাগাইং
মায়ানমারের ভূমিকম্প
fault

ভূমিকম্প কী?

প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট বিভিন্ন ক্রিয়া-কলাপের প্রভাবে ভূ-অভ্যন্তরে আকস্মিক যে ক্ষণস্থায়ী কম্পনে ভূপৃষ্ঠ কেঁপে ওঠে তাকে ভূমিকম্প বলে।

ভূমিকম্পের কেন্দ্র : ভূ-অভ্যন্তরে যেখান থেকে ভূমিকম্প তরঙ্গ প্রথম সৃষ্টি হয় সেই স্থানকে ভূমিকম্পের কেন্দ্র অর্থাৎ ভূমিকম্প তরঙ্গের উৎস স্থান।

উপকেন্দ্র: ভূমিকম্পের কেন্দ্র থেকে ভূপৃষ্ঠের ঠিক উপরে যে স্থানে সর্বপ্রথম ভূমিকম্প তরঙ্গ এসে আঘাত হানে সেই স্থানকে উপকেন্দ্র বলে।ভূমিকম্পের উপকেন্দ্রে ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা সর্বাধিক হয়ে থাকে।

মায়ানমারের ভূমিকম্প ঘটার মুখ্য কারণই কী?

  • মায়ানমার ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান এবং ইউরেশিয়ান প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থান করেছে তার জন্য এখানে ভূমিকম্প একটি সাধারণ ঘটনা।
  • মায়ানমারের প্রধান ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চল হল সাগাইং ফল্ট জোন।
  • সম্প্রতি ২৮ মার্চ ২০২৫ স্থানীয় সময় দুপুর ১২ঃ৫০ এ মায়নামারের মান্দালয়ের নিকট সাগাইং শহরের 16 কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে একটি তীব্র ভূমিকম্প আঘাত হানে রিখটার স্কেলে যার মাত্রা ছিল ৭.৭ এবং কেন্দ্র ছিল ১০ কিলোমিটার গভীরে। যে অঞ্চলে ভূমিকম্প হয়েছে সেটি ইন্দো-বার্মা সাবডাকশন জোনের মধ্যে পড়ে। এছাড়া মায়নামার প্রশান্ত মহাসাগরের আগ্নেয় মেঘলা অঞ্চলের মধ্যে পড়ে।যা পৃথিবীর সর্বাধিক ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চল গুলির মধ্যে অন্যতম।

সাবডাকশন জোন কি?

আমরা জানি পৃথিবীপৃষ্ঠ কতগুলো ছোট বড় প্লেট বা পাতের সমন্বয়ে গঠিত। যখন দুটি পাত পরস্পরের সংঘর্ষে লিপ্ত হয় তখন তুলনামূলক ভারী পাতটি হালকা পাতের নিচে প্রবেশ করে যে অঞ্চল বরাবর ভারী পাতটি হালকা পাতার নিচে প্রবেশ করে সেই এলাকাটিকে সাবডাকশন জোন বলে।

সাবডাকশন জোন, subduction zone
  • মায়ানমারের ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যা প্রায়শই ওই অঞ্চলে ঘটে থাকে, কারণ এটি ভূ-প্রাকৃতিকভাবে একটি সক্রিয় ভূকম্পীয় অঞ্চলে অবস্থিত। মায়ানমার “ইন্ডো-অস্ট্রেলিয়ান” এবং “ইউরেশিয়ান” টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থান করায় ভূমিকম্প এখানে একটি সাধারণ ঘটনা।

ভূমিকম্পের আফটারশক কী?

ভূমিকম্পের আফটারশক (Aftershock) হলো প্রধান ভূমিকম্পের পরে ঘটে যাওয়া ছোট ছোট কম্পন বা ভূমিকম্প, যা প্রধান কম্পনের পরের ঘণ্টা, দিন, এমনকি মাস ধরে অনুভূত হতে পারে।মায়ানমারে ভূমিকম্পের পর 10 ঘন্টায় প্রায় ১৪ টি ভূমিকম্পের আফটারশক অনুভূত হয়েছে।

আফটারশকের কারণ: প্রধান ভূমিকম্পের ফলে ভূত্বকের বিভিন্ন স্তর ব্যাপকভাবে চাপে পড়ে এবং স্থানচ্যুত হয়। এই পরিবর্তনের কারণে ভূত্বক স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার চেষ্টা করে, যার ফলে ছোট ছোট ভূমিকম্প বা আফটারশক সৃষ্টি হয়।

  • মায়ানমারের ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে প্রধান কম্পন এর কয়েক মিনিট পরেই একটি তীব্র আফটার শক অনুভূত হয়েছে। যার রিখটার স্কেলে মাত্রা ছিল ৬.৭

প্রভাব:

এ তীব্র ভূমিকম্প আঘাতে এখন পর্যন্ত ৬৯৪ জন নিহত এবং 1670 জন আহত বলে খবর পাওয়া গেছে। তবে ভূতাত্ত্বিক বিভিন্ন সংস্থা আশঙ্কা করছেন যে মৃতের সংখ্যা প্রায় ১০০০০ ছাড়িয়ে যাবে। মায়ানমারের প্রধান ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চল হল সাগাইং ফল্ট জোন। সাগাইং ফল্ট বা চ্যুতি প্রায় ১২০০ কিলোমিটার বিস্তৃত। এর বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকম্পের ইতিহাস রয়েছে।

  • ভারতের ন্যাশনাল সেন্টার ফর সিসমোলজি (NCS) এর পরিচালক ওপি মিশ্র বলেন-‘সাগাইং চুক্তিটি মায়ানমারের দীর্ঘতম চুক্তি অতীত একই মাত্রার বেশ কয়েকটি ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়েছে’।
  • তিনি আরো বলেন ‘থাইল্যান্ডের ব্যাংকক শহরের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির প্রধান কারণ সাগাইং ফল্ট এর ফাটল ব্যাংককের দিকে অগ্রসর’ ।

এ ভূমিকম্পের প্রভাব এতটা ভয়াবহ যে মান্দালায় অনেক ভবন সম্পূর্ণ রূপে ধসে পড়েছে।

  • বিশেষ করে বৌদ্ধ মঠ, সরকারি ভবন ও আবাসিক স্থাপনাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
  • রাজধানী নেপিদোতেও সরকারি কর্মচারীদের জন্য নির্মিত একাধিক ভবন ধসে পড়েছে। ভবন আবাসিক বড় বড় ঘর বাড়ি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
  • শুধু এই কম্পন মায়ানমারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না প্রতিবেশীদেশ থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককেও ভূমিকম্পের প্রভাব যথেষ্ট পড়েছে সেখানে ৩৩ তলা ভবন ধ্বসে পড়েছে বলে খবর পাওয়া গিয়েছে।
  • মায়ানমারের সামরিক সরকার ছয়টি রাজ্য ও প্রদেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন উদ্ধার অভিযানের জন্য নির্দিষ্ট বাহিনীকে নিয়েও নিয়োজিত করেছেন।
  • বর্তমানে উদ্ধার কাজ চলছে তবে ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো অনেক মানুষ আটকে থাকার আশঙ্কা রয়েছে ।
  • যোগাযোগ ব্যবস্থা একদম বিপর্যস্ত এলাকা সম্পূর্ণরূপে বিদ্যুৎ ও টেলিফোন বিচ্ছিন্ন ফলে সঠিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণে আরো সময় লাগবে বলে আশঙ্কা।

ভারতের সর্বাধিক ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চল (Zone V) :
সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারত (আসাম, অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা), বিহারের উত্তর অংশ, উত্তরখণ্ডের পশ্চিম, হিমালয়ের মধ্যভাগ, জম্মু কাশ্মীরের কাশ্মীর উপত্যকা, গুজরাটের কচ্ছ উপদ্বীপ এবং আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ।

ভূমিকম্প অঞ্চল [Earthquake Zone]মানভারতের অন্তর্গত রাজ্য ও অঞ্চল
ভূমিকম্প ঘটার সম্ভাবনা নেইIছত্তিশগড়, রাজস্থান, কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশের কিছু অংশ।
কম ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলIIতামিলনাড়ু, ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ, ভুপাল।
মাঝারি ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলIIIলাক্ষাদ্বীপ, লখনউ, গুজরাটের অধিকাংশ স্থান, মধ্য ভারত।
অধিক ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলIVকলকাতা ও দক্ষিণবঙ্গ, জম্মু ও কাশ্মীর, দিল্লি, সিন্ধু-গাঙ্গেয় সমভূমি।
সর্বাধিক ভূমিকম্পনপ্রবণ অঞ্চলVগুজরাটের কচ্ছের রান, পশ্চিম ও মধ্য হিমালয়, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, উত্তর-পূর্ব ভারত, পাঞ্জাব, কাশ্মীরের কিছু অংশ।

ভূমিকম্পমাপক যন্ত্রসমূহ (Earthquake Measuring Instruments) :
ভূমিকম্পের তরঙ্গের গতিবিধি পরিমাপের জন্য দু-প্রকার যন্ত্র ব্যবহৃত হয়। যথা-

  1. ভূমিকম্পলিখ যন্ত্র বা সিমোগ্রাফ (Seismograph):

অর্থ: ‘Siesmos’ (সিসমোেস) শব্দের অর্থ ভূমিকম্প এবং ‘graph’ শব্দের অর্থ ‘লেখচিত্র’ বা ‘গতিবিধির লেখ’। সংজ্ঞা : যে যন্ত্রের সাহায্যে ভূমিকম্পের উৎস, ভূমিকম্পের তরঙ্গের গতিবিধি ও তীব্রতার লেখচিত্র (আঁকাবাঁকা রেখার সমষ্টি) পাওয়া যায় এবং ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়, তাকে সিমোগ্রাফ বলে।

আবিষ্কারক: 1892 সালে ব্রিটিশ ভূ-তত্ত্ববিদ জন মিলে (John Milne) সর্বপ্রথম সিসমোগ্রাফ যন্ত্রটি আবিষ্কার করেন।

2.সিমোগ্রাম (Seismogram) বা ভূকম্প পরিলেখ : সিসমোগ্রাফ যন্ত্রে ফোটোগ্রাফিক কাগজে ভূকম্প তরঙ্গের যে আঁকাবাঁকা রেখাচিত্র (Graph) আঁকা হয়, তাকে সিসমোগ্রাম বলে।


Please Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!