GEOFACTS

সুন্দরবনের জানা-অজানা তথ্য

তথ্যে সুন্দরবন:-

location of sundarbans

ভারত ও বাংলাদেশ দুই দেশের মধ্যে বিস্তৃত হল পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ এই সুন্দরবন। সুন্দরবন ২১  ডিগ্রী ৩০মিনিট উত্তর থেকে ২২ডিগ্রী ৪০মিনিট উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮ডিগ্রী  ৫মিনিট পূর্ব থেকে ৮৯ডিগ্রী ৫৫মিনিট পূর্ব -দ্রাঘিমাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত। সুন্দরবনের  ম্যানগ্রোভ অরণ্যের মোট আয়তন প্রায় ১০২৮৪ বর্গ কিমি। এর মধ্যে ৫৮.৫ % অঞ্চল বাংলাদেশে ও বাকি ৪১.৫% অঞ্চল ভারতে অবস্থিত।

ইতিহাস:-

সুন্দরবনের জঙ্গল কেটে আবাদ করে বসতি গড়ে তোলার কাজ প্রথম শুরু করেন টিলম্যান হেঙ্কেল নামে এক ইংরেজ। তিনি ছিলেন যশোহর জেলার ম্যাজিষ্টেট। ১৭৮১ সালে শুরু করে ৬ বছরের মধ্যে তিনি প্রায় ২১ হাজার বিঘার মতো জমিতে জঙ্গল কেটে চাষবাস শুরু করেছিলেন।

১৮১৭ সালে আইনে ঘোষণা করা হয় সুন্দরবন সরকারের সম্পতি। ১৮২২-২৩ সালে ইংরেজ কর্তাব্যক্তি মিঃ প্রিন্সেপ যমুনা থেকে হুগলী নদী পর্যন্ত সমস্ত বনাঞ্চল জরিপ করেন, মিঃ মরিসন এর মানচিত্রের সাহায্যে বনাঞ্চলকে বিভিন্ন ব্লকে ভাগ করেন নির্দিষ্ট ক্রমিক সংখ্যা দিয়ে।

  • সুন্দরবনের সীমানা নির্দেশ করার জন্য দুই ইংরেজ জরিপবিদ ডাম্পিয়ার ও হোজেস জরিপ করেছিলেন ১৮৩০ সালে। সেই জরিপের ফলাফলকে ভিত্তি করে ১৮৭৫ সালে সুন্দরবনের একটি মানচিত্র প্রকাশিত হয়।  এই মানচিত্রে একটি কাল্পনিক রেখা দ্বারা সুন্দরবনের ভূখন্ড সীমাবদ্ধ করা হয়, এই রেখাকে ডাম্পিয়ার হোজেস লাইন বলা হয়
  • কলকাতা বন্দরের ভিড় কমানোর জন্য ১৮৭০ সালে মাতলা নদীর তীরে একটি নতুন বন্দর তৈরির কাজ শুরু হয়। বন্দরের নামকরণ হয় বড়লাট ক্যানিং এর নামানুসারে পোর্ট  ক্যানিং।  আর এই ক্যানিং সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার নামে পরিচিত। কলকাতা থেকে ইংরেজদের তৈরি প্রথম রেলপথ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল এই ক্যানিং পর্যন্ত।
  • প্রায় ২০০ বছর আগে ব্রিটিশরা সুন্দরবনের বনাঞ্চলের প্রথম ফাঁড়ি চালু করেছিল ঘোড়ামারায়।
  • সুন্দরবন যে ক্রমশ মাটির নিচে বসে গেছে, তার প্রমাণ এই অঞ্চলে ৮ফুট থেকে ৮০ ফুট গভীরে মাটির তলায় গাছের দেহাবশেষ পাওয়া গেছে। গড়ে প্রায় ১৮ ফুট নিচে বসে গেছে গোটা সুন্দরবন।1835 – 1840 সালের মধ্যে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে একটি গভীর কূপ খনন করার সময় ৮০ ফুট নিচে সুন্দরী গাছের নিদর্শন লক্ষ্য করা গিয়েছিল। সাধারণভাবে সুন্দরবনের ভূগর্ভস্হ জলতল ভূ-পৃষ্ঠের নিচে ০ থেকে ৩ মিটারের মধ্যে পাওয়া যায়।
  • জোয়ারের সময় সুন্দরবনে নদীর জলের উচ্চতা ১৫-১৮ ফুট পর্যন্ত বাড়তে পারে।যে সব নদী দু’দিক দিয়েই অন্য খাল বা নদীর সাথে যক্তু তাদের ভারানি বলে।
  • যে নদীর উভয়দিক থেকে জোয়ার ও ভাঁটার জল ওঠানামা করে তাকে সুন্দরবনে দোয়ানী বলে। যেমনঃ- দুর্গাদোয়ানী নদী।

গত দুই দশকে ভারতীয় সুন্দরবনে বেডফোর্ড, সুপারিভাঙা, কাবাসগাদি, লোহাচারা, এই চারটি দ্বীপ উপগ্রহের ছবি থেকে মুছে গেছে। লোহাচারা বিশ্বের প্রথম ডুবে যাওয়া দ্বীপ, যেখানে জনবসতি ছিল। বিশ্ব উষ্নায়নের প্রভাবে গত দু’দশক ধরে সুন্দরবনের জলস্তর গড়ে ৩.১৪ মিলিমিটার বাড়ছে প্রতি বছর, যেখানে সারা বিশ্বের বার্ষিক গড় ২ মিলিমিটার। সুন্দরবনের সমুদ্র জলতলের বৃদ্ধির হার অনুযায়ী আগামী ৫০-৯০ বছরে সুন্দরবনের অর্ধেক এলাকা জলের তলায় তলিয়ে যাবে, ধারণা সমুদ্র বিজ্ঞানীদের।

সুন্দরবনের লবনাক্ত মাটিতে জন্মানো গাছগুলিকে ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ বা মঙ্গল বলে। এই গাছ লবণ সহ্য করতে পারে। এছাড়া সুন্দরবনের পরিবেশে নিজেদের অভিযোজিত করতে নানা রকম বৈশিষ্ট্য দেখা যায়।যেমন-শ্বাস মূল, ঠেস মূল, জরায়ুজ অঙ্কুরোদগম। সুন্দরবনের সুন্দরী,গরান কাঠে উই লাগে না। হরগোজা গাছের পাতার নির্যাসে ক্যানসার প্রতিরোধক ক্ষমতা আছে। বিশেষত লিভার সংক্রান্ত ক্যানসারের ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত উপকারী। সুন্দরবনে সর্বাধিক বিপন্ন প্রজাতির গাছ দুটি হল সুন্দরী ও গোলপাতা।

রাজ কাঁকড়া

এখানকার রাজ কাঁকড়াকে দেখতে অশ্বক্ষুরের মত, প্রজাতিটি একটি জীবন্ত জীবাশ্ম। এদের উদ্ভব আজ থেকে ৪কোটি বছর আগে।এদের নীল রক্ত থেকে অ্যামিবোসাইট লাইসেট ও ক্যানসারের ওষুধ তৈরি হয়।

রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার’ নামে কোন ভিন্ন প্রজাতির বাঘ সুন্দরবনে নেই। আসলে ১৮৫৭ সালে কলকাতায় আসেন ইংল্যান্ডের রয়্যাল পরিবারের সদস্য ‘প্রিন্স অফ ওয়েলস’, পরে যিনি সপ্তম এডওয়ার্ড হয়েছিলেন। কলকাতায় থাকাকালীন তিনি শিকারে গিয়ে বড়মাপের একটি বাঘ মেরেছিলেন। তারপর থেকেই এই নাম। সুন্দরবন ছাড়া পৃথিবীর আর কোন ম্যানগ্রোভ অরণ্যেই বাঘ নেই।

Royal Bengal Tiger
Royal Bengal Tiger
  • ১৯৭৩ সালে ভারতের ৯টি বনভূমিকে টাইগার রিজার্ভ বলে ঘোষণা করা হয়। সুন্দরবন তার মধ্যে একটি।
  • বাংলায় প্রবাদ আছে ‘ বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা‘।এর পিছনে আছে বাঘের শারীরিক বৈশিষ্ট্য। বাঘের সামনের পায়ের থাবা দুটিতে আছে ৫টি করে দশটি নখ আর পিছনের দুটিতে চারটি করে ৮টি। তাই বাঘে ছুলে আঠারো ঘা।
  • ২০১২-২০১৩ সালে WWF-India ও WII এর ক্যামেরা ট্র্যাপিং এর মাধ্যমে চালানো সমীক্ষা থেকে ১০৩টি বাঘের অস্তিত্ব জানা যায় ভারতীয় সুন্দরবনে।
  • সুন্দরবনের প্রধান মৎস্যবন্দরগুলি হল কাকদ্বীপ,  ফ্রেজারগঞ্জ ও নামখানা।
  • ইউনেস্কো ১৯৮৭ সালে সুন্দরবনকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ঘোষণা করে।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘জল জঙ্গলের কাব্য’ উপন্যাসটি সুন্দরবনের পটভূমিতে লিখিত।এছাড়া মনিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘হলুদ নদী সবুজ বন’, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কিশোর উপন্যাস ‘সুন্দরবনে সাত বছর’  ইত্যাদি।

ম্যানগ্রোভ মৃত্তিকা:- ম্যানগ্রোভ মৃত্তিকায় ম্যানগ্রোভ বৃক্ষসমূহের বন সুন্দরবন গড়ে উঠেছে। সুন্দরবনের বদ্বীপীয় পলি মৃত্তিকা গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র ও তার উপনদী বাহিত হিমালয়ের পলি দ্বারা সৃষ্ট হয়েছে। এই মৃত্তিকাকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা –

i) উত্তর ভাগে সিল্টযুক্ত কর্দম।
ii) মধ্যভাগে পিট এবং
iii) দক্ষিণভাগে লবণাক্ত জালভূমির মৃত্তিকা।

কাকদ্বীপ:-

এই দ্বীপে কাকের আধিক্যই নামকরণের কারণ।

ক্যানিং:-

মাতলা নদীর তীরের প্রাচীন বন্দর শহরটির আগের নাম ছিল মাতলা গ্রাম।  কলকাতার বন্দরের সহযোগী বন্দর হিসাবে এখানে বন্দর গড়ার পরিকল্পনা নেয় ইংরেজ সরকার। সে সময় ভারতের বড়লাট ছিলেন আর্ল অফ ক্যানিং। তাঁর নামে  এই বন্দর শহরের নামকরণ হয়।

গোসাবা:-

গোরু, সাপ আর বাঘের আদ্যক্ষর নিয়েই গোসাবা নামের উৎপত্তি।

জয়নগর:– জয়নগরের মোওয়া আমাদের সকলের প্রিয়। জয়চন্ডী দেবীর নাম অনুসারে সুন্দরবনের জয়নগরের নামকরণ।

ডায়মন্ডহারবার:-

স্থানীয় নাম হাজিপুর। বাণিজ্য জাহাজ নোঙর করার সুবিধাজনক স্থানের জন্য ইংরেজরা এই স্থানের নাম দেয় ডায়মন্ডহারবার।

সক্রিয় বদ্বীপ:- উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার দক্ষিণাংশে এই বদ্বীপ অঞ্চল অবস্থিত। এই অংশ প্রকৃতপক্ষে সুন্দরবন নামে পরিচিত।

বদ্বীপ গঠনের কাজ এখনও পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণে সুন্দরবন অঞ্চলে হয়ে চলেছে। এখানে সুন্দরী গাছ বেশী জন্মায় বলে, তার থেকে সুন্দরবন নামকরণ হয়েছে। এই অঞ্চলে পলিপূর্ণ নদী মোহনায় সাগরের সাথে মিলিত হলে নদীর গতিবেগ কমে যায়। সাগরে লবণাক্ত জলের সংস্পর্শে এলেই পলি সংযুক্ত হয়ে দানা বাঁধে। তারপর ধীরে ধীরে নদী বক্ষে থিতিয়ে পড়ে। এভাবে থিতিয়ে পড়তে পড়তে নদীর মাঝে পড়ে চরা এবং জলস্তরের উপরে চরা জেগে উঠে জলধারাকে দ্বিধাবিভক্ত করে। ক্রমে বহুধাবিভক্ত হয়ে অনেক শাখার সৃষ্টি হয়। এখানেই ভাগীরথী ও হুগলীর বহু শাখা-প্রশাখা মিলে এক বিস্তৃত নদী জাল সৃষ্টি হয়েছে। এখানে বহু জোয়ারীয় খাঁড়ি (tidal creek) রয়েছে। এই শাখানদীগুলির মোহনাতে আবার চরা সৃষ্টি করে আবার দ্বিধাবিভক্ত হয়। বারংবার এই পদ্ধতি চলতে থাকে। আর এই পদ্ধতির ফলে বিভিন্ন শাখার পুর্নমিলন ও পুর্নবিভক্তিকরণ চলতে থাকে। এক সময় চরগুলো সংযুক্ত হয়ে নতুন নামহীন দ্বীপের জন্ম দেয়। সাগরদ্বীপ, বকখালি, নামখানা, পাথরপ্রতিমা প্রভৃতি দ্বীপগুলো এভাবে সৃষ্টি হয়েছিল। এরূপ আরো অনেক দ্বীপ পশ্চিমবঙ্গের উপকূলীয় বঙ্গোপসাগরে গর্ভাবস্থায় আছে। যে কোন মুহূর্তে তাদের জন্ম হতে পারে। সাম্প্রতিক বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে ওঠা নতুন দ্বীপটির নাম দেওয়া হয়েছে পূর্বাশা।

গঙ্গা বদ্বীপের সক্রিয় অংশে সপ্তমুখী, রায়মঙ্গল, মাতলা, গোসাবা, বড়তলা, জামিরা, হরিণভাঙ্গা প্রভৃতি নদীগুলিতে জোয়ার-ভাঁটার প্রভাবের ফলে ভূমিগঠন প্রক্রিয়া কার্যকরী হয়েছে। এই নদীগুলি এত বেশী চওড়া যে এগুলি সাগরের এক একটি বাহু বলে মনে হয়।

Please Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!